গত ৮ মাস ধরে স্বেচ্ছায় কারাবন্দি রয়েছেন দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তাকে গ্রেফতারের পর ৮ মাস পার হলেও নয় মামলায় এখন পর্যন্ত তিনি জামিন না চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।
তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মাহমুদুর রহমান এখন স্বেচ্ছায় কারাবন্দি। তিনি জামিন না চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় তাকে জামিনে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না। নইলে এতোদিনে হয়তো তাকে জামিনে বের করে আনা সম্ভব হতো।
গত ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি-কথোপকথন প্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার হন মাহমুদুর রহমান। এরপর তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে তিন মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
ওই দিন মাহমুদুর রহমানকে ২৪ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। এরপর তাকে আরও ছয় মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
সেদিন শুনানির শুরুতেই মাহমুদুর রহমান তার পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কোনো আইনজীবীর ওকালতনামায় স্বাক্ষর করবো না। কেন না আমি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করবো না। কারণ, এ আদালতের প্রতি আমার কোনো আস্থা নেই। আমার পক্ষে কোনো দরখাস্ত কিংবা আবেদন করারও কোনো দরকার নেই। ২৪ দিন কেন ২৪০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলেও আমি কোনো আইনজীবী রাখবো না।
মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, মাহমুদুর রহমান নিজেই জামিন চাচ্ছেন না। তার ধারণা, তাকে জামিন দেওয়া হবে না। আর আদালত জামিন দিলেও সরকার তাকে ছাড়বে না। তাকে জেলগেট থেকে ফের গ্রেফতার করা হবে। তার নামে অযথা আরও কিছু মামলা বাড়িয়ে কী লাভ?
তিনি আরও বলেন, মাহমুদুর রহমানের আশঙ্কা, জামিন দেওয়া হলেও তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়বে। মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হবে। সর্বোপরি এ সরকারের আমলে ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় তিনি জামিনের আবেদন করা থেকে বিরত রয়েছেন।
মাহমুদুর রহমানের আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে ন্যায়বিচার পাবেন না জেনেই তিনি কোনো জামিনের আবেদন করছেন না।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেছেন, গ্রেফতারের পরদিনই মাহমুদুর রহমান আদালতে বলেছিলেন, আদালতের ওপর তার কোনো আস্থা নেই। তার ওই কথা বজায় রাখতেই জামিন না চেয়ে ইচ্ছা করেই কারাগারে রয়েছেন তিনি। তিনি জামিন চাইবেন কি চাইবেন না, এটা তার ব্যাপার। তিনি জামিন চাইলে তা মঞ্জুর করা না করা আদালতের এখতিয়ার। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জামিন না দিলে জজ আদালত, জজ আদালত জামিন না দিলে হাইকোর্টে তিনি জামিনের আবেদন করতে পারতেন। এতো আসামির জামিন হয়, তার হতো না? আসলে তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই জামিন চাচ্ছেন না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপিতে কথোপকথন হ্যাকিংয়ের অভিযোগে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তেজগাঁও একটি মামলা হয়। মামলাটি করেন ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। এ মামলায় গত ১১ এপ্রিল মাহমুদুর রহমানকে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়।
মাহমুদুর রহমানের অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বাংলানিউজকে বলেন, ওই মামলায় সে সময় হাইকোর্টে জামিন চেয়ে পাননি মাহমুদুর রহমান। যেহেতু হাইকোর্টেই তিনি জামিন পাননি, সেহেতু নিন্ম আদালতেও জামিন চাননি।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানি দেওয়া, ব্লগারদের লেখা ইন্টারনেট থেকে নিয়ে দৈনিক আমার দেশে প্রকাশ করে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত দেওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দৈনিকটিতে আদালত, সরকার ও ট্রাইব্যুনালসহ নানা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখালেখির অভিযোগ রয়েছে।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন মেজবাহ জানান, বর্তমান সরকারের আমলে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৬৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি মামলা চলমান আছে, একটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন। চলমান ১৭টি মামলার মধ্যে ৯টি মামলায় তিনি জামিন না চেয়ে কারাগারে আটক আছেন। ৮টি মামলায় জামিনে আছেন। আর বাকি ৪৭টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে।
চলমান মামলাগুলোর মধ্যে ৪টি শাহবাগ থানার, ৪টি তেজগাঁও থানার ও একটি আদালতে দায়ের করা নালিশি মামলা রয়েছে।
স্বেচ্ছা কারাবন্দি নয়, হাইকোর্টেও জামিন না পাওয়ায় মাহমুদুর রহমান বিনা বিচারে গত ৮ মাস ধরে কারাবন্দি বলেও দাবি তার আইনজীবীদের।
মাহমুদুর রহমানের আরেক আইনজীবী বেলাল হোসেন জসীম জানিয়েছেন, এর আগে ২০১০ সালের ১ জুন গ্রেফতার হন মাহমুদুর রহমান। ৯ মাস ১৭ দিন কারাভোগের পর ২০১১ সালের ১৭ মার্চ তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
ওইদিন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বৈধ প্রকাশক না থাকার অভিযোগে পত্রিকাটির ডিক্লারেশনও বাতিল করা হয়। এরপর আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই সময় কারাগারে থাকা ৯ মাস ১৭ দিনের মধ্যে আদালত অবমাননার অভিযোগে ৬ মাসের কারাদণ্ডও ভোগ করেন মাহমুদুর রহমান। ‘চেম্বার জজ মানেই স্টে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আদালত অবমাননার দায়ে তাকে ওই কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।