বাঙালির মহান বিজয়ের দিনে এ আরেক অর্জন। যাকে বলে ‘লাল সবুজের বিশ্বজয়।’ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর বিশ্ববাসী আর এত বড় লাল সবুজের মিলন দেখেনি, যেটা দেখাল দেশের তরুণ প্রজন্ম। বিজয় দিবসের মধ্যাহ্নে লাল আর সবুজ বোর্ড মাথার ওপর তুলে ধরল ২৭ হাজার ১১৭ কিশোর-তরুণ। সঙ্গে সঙ্গে শেরেবাংলা নগরের প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে সূর্যের দিকে মুখ তুলে হাসল বাংলাদেশের পতাকা। এর সঙ্গে পৃথিবীর বুকে লেখা হয়ে গেল আরেকটি নতুন ইতিহাস। এই মানবপতাকা তৈরি করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। ৪২ বছর আগে এদিনটিতে এদেশের বীর সন্তানরা বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছিল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। আজ সেই ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবপতাকা তৈরি করে নতুন রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর আট হাজার সদস্যসহ রাজধানী ও এর আশপাশের ৬৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর অংশগ্রহণে এই মানবপতাকা তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় গতকাল সকাল ৯টা থেকে। কয়েক দফা মহড়ার পর বেলা ১টা ৩৬ মিনিটে শুরু হয় চূড়ান্ত চেষ্টা। লাল-সবুজের প্লাকার্ডগুলো ৬ মিনিট ১৬ সেকেন্ড ২৭ হাজার ১১৭ জন অংশগ্রহণকারী মাথার ওপর তুলে রেখে বিশ্বের বৃহৎ মানবপতাকা তৈরির চেষ্টা করে। এ সময় মঞ্চে বেজে ওঠে ‘বিজয়-নিশান উড়ছে ওই’ এবং ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গান দুটি। এই গানগুলো ১৯৭১ সালে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। সেই গান পরিবেশনের পাশাপাশি তৈরি হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘লাল সবুজের বিশ্ব জয়ের’ মঞ্চ।
সবচেয়ে বড় এই মানবপতাকার লাল অংশ প্রস্তুত করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আর সবুজ অংশ তৈরি করে ঢাকা কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, শাহীন কলেজসহ ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। চূড়ান্ত পতাকা তৈরির আগে ১টা ১৬ মিনিটে ৩০ সেকেন্ডের প্রথম মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আফজাল হোসেন এবং মডেল অপি করিম। আর ‘লাল সবুজের বিশ্বজয়’ শিরোনামে এ আয়োজনের উদ্যোক্তা মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড। এর সার্বিক সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এর আগে গতকাল সকাল থেকে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর সদস্য ও রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত পরিবহনে প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করতে থাকে। তবে সকাল ৮টা পর্যন্ত কোনো সাধারণ জনগণকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে পতাকা তৈরির প্রস্তুতি। এরপর মানবপতাকার চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্য প্লাকার্ড হাতে সবাইকে নির্ধারিত স্থানে পাঠানো হয়। প্যারেড গ্রাউন্ডে নির্দিষ্ট মাপের মধ্যে সাদা চুন দিয়ে ৩০ হাজার ছোট ছোট ঘর করে দাগ দেয়া হয়। প্রত্যেক ঘরে একজন করে নির্দিষ্ট রঙের প্লাকার্ড নিয়ে অবস্থান করে। শুরুতেই রবির চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং সেনাবাহিনীর নবম ইনফিনট্রি ডিভিশন ও সাভার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বীরবিক্রম, অংশগ্রহণকারীদের শুভকামনা জানিয়ে কার্যক্রমের সূচনা করেন।
প্রথমেই গিনেস রেকর্ড কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পাঠানো শুভকামনা সূচক একটি ভিডিও বার্তা দেখানো হয়। এরপর ‘আমরা সবাই এক রকম নয়, আমরা সবাই এক’ ধ্বনি তুলে সমন্বয়কদের নির্দেশে প্রথমে দু’বার মহড়া দেয়া হয়। অংশগ্রহণকারীদের মাথার ওপর প্রদক্ষিণ করতে থাকে হেলিকপ্টার। মহড়া শেষে আসে চূড়ান্ত মুহূর্ত।
গিনেজ বুক কর্তৃপক্ষের নিয়মানুসারে ‘স্টার্ট’ বলে নির্দেশ দেয়ার পর সবাই একসঙ্গে তাদের হাতে থাকা প্লাকার্ডটি মাথার ওপর তুলে ধরে। মাইকে বেজে ওঠে লাল সবুজের জয় গান। শুরু হয় কাউন্ট ডাউন। উদ্দেশ্য ৫ মিনিট ধরে মানবপতাকা স্থায়ী করা। একপর্যায়ে থেমে যায় গান। লাল সবুজের বিশ্বজয় হয়। ঘড়ির কাঁটাতে তখন ১টা ৪১ মিনিট পার হয়ে ১৬ সেকেন্ড। মোট ৬ মিনিট ১৬ সেকেন্ড ধরে মাথার ওপর প্লাকার্ডগুলো তুলে রাখে অংশগ্রহণকারীরা।
আয়োজনটি দেখার জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান অডিট ফার্ম হুদাবাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির ১৮ জন পর্যবেক্ষক উপস্থিত ছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে ধারণ করা স্থির ও ভিডিওচিত্র প্রমাণ হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট শর্তাবলি মেনে আয়োজনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে কি-না কর্তৃপক্ষের এ যাচাই-বাছাইয়ের পর ২ দিনের মধ্যে ফলাফল জানানো হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
গিনেস বুকে সবচেয়ে বড় মানবপতাকা তৈরির আগের রেকর্ডটি পাকিস্তানের। গত বছর অক্টোবরে লাহোর হকি স্টেডিয়ামে পাঞ্জাব ইউথ ফেস্টিভাল উপলক্ষে ওই মানবপতাকায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২৪ হাজার ২০০ জন পাকিস্তানি। অবশ্য চলতি বছরে ২৬ হাজার ৯০৪ জনের মানবপতাকা তৈরি করে পাকিস্তানের এ রেকর্ড ভাঙে রাশিয়া।
বৃহৎ এ কর্মযজ্ঞ উপলক্ষে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবপতাকা তৈরির মাধ্যমে বিশ্বের কাছে আমাদের জাতীয় ঐক্য তুলে ধরতেই এ চেষ্টা।
রবির কমিউনিকেশনস কর্মকর্তা তালাত কামাল জানান, গিনেসের সব নিয়ম মেনে সুষ্ঠুভাবে মানবপতাকা তৈরি হলো কি-না, তার প্রমাণ হিসেবে তথ্য ও ছবি পাঠাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অডিট প্রতিষ্ঠান হুদাবাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে আমাদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা নতুন রেকর্ড হলে গিনেস কর্তৃপক্ষই সে ঘোষণা দেবে। এখন আমরা সেই ঘোষণার অপেক্ষায়।
অনুষ্ঠান বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হতে প্রায় ১টা বেজে যায়। ফলে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় রোদে দাঁড়িয়ে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান সবার জন্য উন্মুক্ত এমন প্রচার করা হলেও এটি ছিল শুধুমাত্র আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্য। ফলে অনেক মানুষ অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে না পেরে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়া অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার কারণে সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ায় ওই এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

মানব পতাকা