আমি বাঁচতে চাই। আপনারা আমাকে বাঁচতে দিন। হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তি করার পরও তার মধ্যে দেখা গেছে বাঁচার অদম্য বাসনা। যখনই চোখ মেলে তাকাতেন-দেখতেন পাশেই মলিন বদনে দাঁড়ানো হতভাগা স্বামী মাহবুব। স্বামীর হাত ধরেও জানতে চাইতেন আমি কবে ভাল হব। তাঁর এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারতেন না স্বামী, ডাক্তার, নার্স-কেউ-ই। মিথ্যা আশ্বাসে স্বামী তাঁকে প্রবোধ দিতেন। এত কিছু করার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। স্বামী ডাক্তার নার্স কেউ-ই তাকে বাঁচাতে পারেননি। টানা ১৩ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান তিনি। সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে বুধবার নগরীর একটি বার্ন ক্লিনিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তখনও পাশে দাঁড়ানো ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ এক আদর্শ স্বামী মাহবুব। স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে মাহবুব এখন প্রায় শোকে পাথর। কিছুই বলতে চান না, কিছুই বলতে পারছেন না। স্ত্রীর নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছেন।
মাসুমা ছিলেন সেই অভিশপ্ত বিহঙ্গ পরিবহনের যাত্রী- যা গত ২৮ নবেম্বর সন্ধ্যায় শিবির ছাত্রদলের ক্যাডাররা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। মুহূর্তেই অগ্নিদগ্ধ হলো ১৯ যাত্রী। সবার সঙ্গে মাসুমাকেও নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। স্বামী মাহবুব হোসেন জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য মাসুমাকে এলিফ্যান্ট রোডের ‘ঢাকা বার্ন হাসপাতালে’ ভর্তি করা হয়। সেখানেই বুধবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন কর্মমুখী। জীবনকে পরিপূর্ণ করতে, অর্থবহ করতে তারা নিরলস সাধনা করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর মাসুমা যোগ দেন রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে। তাঁর কর্মস্থল ছিল শ্যামবাজার। স্বামী মাহবুব হোসেনও কর্মজীবী। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। থাকতেন ফার্মগেট এলাকায়। মাসুমার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর ভেলানগর এলাকায়।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাসুমা তাঁকে সর্বশেষ কী কথা বলেছেন, জানতে চাইলে মাহবুব বলতে থাকেন কী আর বলবে। সে তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারত না। আগুনে পোড়ার জ্বালা কতটা দুঃসহ সেটা শুধু বার্ন ইউনিটে যাঁরা আছেন, তাঁরাই অনুধাবন করছেন। এটা ভাষায় কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। মাসুমা হয়ত আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তাঁর অবস্থা ভাল নয়। বেঁচে থাকা নিয়ে ছিলেন সন্ধিহান। যে কারণে যখনই কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ মেলে তাকাতেন, প্রশ্ন রাখতেন আমি বাঁচব তো? আমার মুখ কি ভাল হবে? আমার চেহারা কি বিকৃত হয়ে যাবে? আমি কি আগের মতো স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব?
মাসুমা বেঁচে থাকার জন্য যে কী ধরনের আকুতি-মিনতি করেছিলেন তা কেবল মাহবুবই পাশে থেকে অনুধাবন করেছেন। মাহবুব বলেন প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ব্যাংকে যেতেন। ফিরতেন বিকেলে। সেদিনও তিনি শ্যামবাজার থেকে ফেরার সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে মিরপুরগামী বাস বিহঙ্গে ওঠেন। তিনি ছিলেন বাসের সামনে মহিলা সিটে।
কী ভাবে প্রথম জানতে পারলেন এ দুঃসংবাদ। জবাবে মাহবুব বলেন, শাহবাগ থেকে একজন বাদামবিক্রেতা আমার মোবাইল ফোনে জানায়। আমি তাৎক্ষণিক ছুটে আসি। প্রথমে ঘটনাস্থলে, পরে হাসপাতাল। ভর্তির পর পরই মাসুমা কিছু কথা বলতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাসুমা আমাকে জানিয়েছে, তিনি সামনের সিটে বসা থাকাবস্থায় শাহবাগের কাছাকাছি আসতেই দুজন যাত্রী বাস থেকে নেমে যায়। তার পরই হঠাৎ তার গেটের কাছে একটা শব্দে আগুন ধরে যায়। চালক তখন কিছুটা চালিয়ে বাসটাকে সামনে নিয়ে আইল্যান্ডের ওপর উঠিয়ে দেয়। এ সময় বাস থেকে সবাই যে যার মতো নামতে থাকে। মাসুমাও আগুনের ওপর লাফ দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে যায়।
