১৯ বছর বয়সী আয়েশা আক্তার ২৪শে এপ্রিল সকাল পর্যন্ত রানা প্লাজায় নিউ ওয়েভ ষ্টাইলস লিমিটেডে মেশিন অপারেটরের কাজ করতেন।
সকাল সাড়ে নটার পরই বদলে যায় সব।
দুর্ঘটনার দিন অল্প আঘাত নিয়ে বেচে ফিরেছেন কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেন নি।
এখনো বড় বড় উঁচু ভবন দেখলে ভয় পান আয়েশা আক্তার।
বললেন, “আমি জানি সব বিল্ডিংতো আর এভাবে ভেঙ্গে পড়বে না। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়টা এখনো দুর হয়নি”
আয়েশা জানালেন পোশাক শিল্পের পুরনো পেশায় আর ফিরে যাবেন না।
তিনি বলছিলেন, “বাবা মায়ের সংসার চলে না তাই পেটের টানে কাজ করেছি। কিন্তু এখন আমার বাবা মাই আর চান না আমি ঐ পেশায় আর ফিরে যাই। তাদের কথা হলও বেচে ফিরেছি তাই কতো”
রানা প্লাজা ধ্বসের ছয় মাসে পরে এসেও আয়েশা আক্তার নতুন পেশার খোজে রয়েছেন।
রানা প্লাজার সেই জায়গাটুকু থেকে কয়েক মিনিট হেটে গেলে ল্যাব-জোন নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
রানা প্লাজায় হেলপারের কাজ করতেন শ্রাবণ আহমেদ জাহাংগীর।
আজ এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পিওনের কাজ করছেন অর্ধেক কম বেতনে।
“আগে গার্মেন্টসের কাজে আট হাজার টাকা বেতন পেতাম। এখন পিওন হিসেবে বেতন মাত্র তিন হাজার টাকা। আমার ঘর ভাড়াই তিন হাজার টাকা। তাতে খুবই দুর্দিনে আছি”
ঘড় ভাড়া দিতে আগের দিনই মোবাইল ফোনটি বিক্রি করেছেন জাহাংগীর।
রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার সময় সেদিন ৫টি গার্মেন্টস কারখানায় জাহাংগীরের মতো কতজন শ্রমিক কাজ করতেন তার পরিষ্কার হিসেব এখনো মেলে না।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ আনুমানিক তিন হাজার শ্রমিকের হিসেব দেয়।
ঘটনার দিন থেকে ১৭ দিন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করার কথা জানায় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
গুরুতর আঘাত নিয়ে ঢাকা ও তার আশপাশে নানা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন উদ্ধার হওয়া সাড়ে আটশোর মতো শ্রমিক।
ধীরে ধীরে তাদের সবাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও ১৫ জন এখনো ডাক্তারের ছাড়পত্র পাননি।
ঢাকা ও সাভারের তিনটি হাসপাতালে নানান জটিলতা নিয়ে এখনো চিকিৎসাধীন তারা।
পঙ্গু হাসপাতালের সিডি ওয়ার্ডের মোসাম্মৎ রেবেকা খাতুনের দুপায়ে মোট আটবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে হাঁটুর বেশ উপর থেকে। অন্যটি গোড়ালির উপর থেকে।
রেবেকা জানালেন আরও একবার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে বলে তাকে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
তিনি বলছিলেন, “রমজানের ঈদের ছুটিতে ডাক্তার সবাই বাড়ি যায়। ফিরে এসে দেখে আমার একটা পায়ে আবার ঘা হয়ে গেছে। সেটাকে তারা আবার কেটেছে। এখন শুনছি আবার অপারেশন করতে হবে”
সেদিনের ঘটনায় রেবেকার মতো ৩৫ জন শ্রমিক অঙ্গহানি ও মেরুদণ্ডের আঘাতে পুরোপুরি পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন।
এর বাইরে হাতে ও পায়ে নানা ধরনের গুরুতর আঘাত নিয়ে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে তিনশ জনের মতো।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে এমন একজন কমপ্লায়ান্স অফিসার আবুল কালাম আজাদ।
কয়েকদিন পর সিআরপি থেকে ছাড়া পাবেন।
কিন্তু বাড়ি ফিরে কিভাবে সংসার সামলাবেন সেটাই এখন ভাবছেন।
তিনি বলছিলেন, “যখন রানা প্লাজায় কাজ করতাম, আমার একটা নির্দিষ্ট বেতন ছিল তা দিয়ে হিসেব করে সংসার চালাতাম। এখন সেই মাসিক বেতন তো আর নাই। পঙ্গুতে থাকা অবস্থায় যে অর্থ সহযোগিতা পেয়েছি তা পাঁচ মাসে শেষ”
তিনটি মেয়ে স্কুল ও কলেজে পড়াচ্ছিলেন মি: আজাদ।
কদিন পর যখন সিআরপি থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাবেন তখন বাড়ির খরচ কিভাবে জোটাবেন সেটা এখন প্রধান দু:শ্চিন্তার বিষয় প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন আবুল কালাম আজাদে জন্যে।
একসময়কার সক্ষম আজাদ এখন ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন।
সিআরপির কেন্দ্রে তার মত ১৬৮ জনকে নানা ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় এরকম শারীরিক আঘাতপ্রাপ্তদের খবর নানাভাবে মিললেও মনের ক্ষত নিয়ে যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন তাদের খবর পাওয়া বেশ মুশকিল।
সেই মানুষদের যারা সেদিন কাজ হারিয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ এখনো কাজে ফিরতে পারেন নি।
এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ বলছে তারা এরকম ১৪০০ জনের খবর পেয়েছেন।
যাদের অনেকেই কাজ করছেন দিন মজুর বা রিক্সা ওয়ালা হিসেবে।
নারী শ্রমিকদের অনেকেই গেছেন গৃহ-শ্রমিকের কাজে।
গ্রামেও ফিরে গেছেন অনেকে।
তবে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে ভিন্ন কথা।
বিজিএমইএর সহসভাপতি এস এম মান্না বলছেন, “আমাদের জানা মতে শ্রমিকদের বেশিরভাগই স্ব-উদ্যোগে কাজে ফিরতে পেরেছেন। আমাদের কাছেও কাজ চেয়েছেন অনেকে। এরকম ৭০ জনকে আমরা কাজ দিয়েছি”
তবে বাদবাকি যারা কাজ হারিয়েছেন তারা কোথায় আছেন তার কোন তথ্য বিজিএমইএর কাছে মেলেনি।
যদিও ঘটনার পরপরই রানা প্লাজার শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ দেবার কথা বলেছিলেন বিজিএমইএর নেতৃবৃন্দ।
বাংলাদেশের স্বরনকালের ইতিহাসের সবচাইতে বড় শিল্প দুর্ঘটনার ৬ মাস পর আয়েশার মতো শ্রমিকেরা খুঁজছেন নতুন পেশা, জাহাংগীরের মতো অনেকে নতুন পেশায় ফিরে গেলেও অর্থাভাবে হিমশিম খাচ্ছেন।
আর রেবেকার মতো প্রতিবন্ধিতার শিকার শ্রমিকেরা কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনের কতটা কাছাকাছি পৌছাতে পারবেন, সেই আশংকায় রয়েছেন।
তাদের সেইসব আশংকা, উদ্বেগ ছাড়িয়ে সাভারের রানা প্লাজার আশপাশের সেই যায়গাটুকু অবশ্য ফিরে পেয়েছে তার পুরনো চেহারা।