মাহমুদুর রহমান
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় প্রায় একদলীয় সংসদে ২৯৩টি আসন আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। জ্বি হুজুর মার্কা সেই সংসদে মাত্র এগারো মিনিটের আলোচনায় চতুর্থ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে বাংলাদেশে একদলীয় ফ্যাসিবাদী বাকশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা হয়। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, চতুর্থ সংশোধনী ছিল সেই চেতনার সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পাঁচ বছরের মেয়াদে প্রথম সংসদ গঠিত হলেও চতুর্থ সংশোধনীর ৩৩ অনুচ্ছেদের বলে আইন প্রবর্তনের দিন থেকে আরও পাঁচ বছরের জন্য সেই সংসদের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থাত্ জনগণের ম্যান্ডেট পাঁচ বছরের জন্য হলেও সংসদ সেটিকে রাতারাতি সাত বছরে রূপান্তরিত করে। অনুচ্ছেদটি ছিল নিম্নরূপ—
“৩৩। প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি।- সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ, রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙিয়া দিয়া না থাকিলে, এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বত্সর অতিবাহিত হইলে ভাঙিয়া যাইবে।” (সূত্র : সংবিধান, মুদ্রণ : ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ১০৮)
এ তো গেল সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর তরিকা। আরও মজার কাণ্ড করা হয় রাষ্ট্রপতির বেলায়। চতুর্থ সংশোধনীতে ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদ আনয়ন করে আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত আগের রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়। সেই অনুচ্ছেদে বলা হয়—
“৩৪। রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান।- সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে,
(ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে;
(খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।” (সূত্র : সংবিধান, মুদ্রণ : ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ১০৮)
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘জাতির পিতা’ টাইটেল ব্যবহার করা না
হলেও চতুর্থ সংশোধনীতে সেটি প্রথমবারের মতো করা হলো।
পূর্বমুহূর্তের প্রধানমন্ত্রী চোখের পলকে নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি বনে গেলেন। স্বয়ংক্রিয় সেই রাষ্ট্রপতির মেয়াদ নির্ধারণের জন্য অনুচ্ছেদ ৫১ নিম্নোক্তভাবে তৈরি করতে হয়েছে :
“৫১। রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ :- (১) এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বত্সরের মেয়াদে তাহার পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন ঃ
তবে শর্ত থাকে যে, রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তাহার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।” (সূত্র : সংবিধান মুদ্রণ : ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৯৯)
একজন স্বৈরশাসকের মন-মানসিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রয়েছে আমাদের সংবিধানের এই চতুর্থ সংশোধনী। নির্বাচনের কোনো বালাই নেই, অথচ সংসদে ব্রুট মেজরিটির শক্তিতে ধরে নিতে হবে ‘যেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন’। এগারো মিনিটের মধ্যে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের গণধিকৃত একদলীয় বাকশালের আয়ু ছিল মাত্র ৬ মাস ২০ দিন। আমাদের ‘মহা পণ্ডিত’ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনীর ওপর খড়গহস্ত হলেও বিস্ময়করভাবে চতুর্থ সংশোধনীতে সংবিধানের মূল নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু খুঁজে পাননি। বরং তার সেই কুখ্যাত মুন সিনেমা মামলার রায় বিশদভাবে পর্যালোচনা করলে চতুর্থ সংশোধনীর প্রতি এই বিচারপতির নৈতিক সমর্থনই খুঁজে পাওয়া যাবে। তার রায়ে চতুর্থ সংশোধনীর পক্ষে নানা রকম অসার যুক্তি উপস্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা থেকেই সাবেক প্রধান বিচারপতির আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি চরম পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মিলবে।
আমার আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার উদ্দেশ্য প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সেই রায় বিশ্লেষণ না হলেও দেশের বর্তমান বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার স্বার্থে রায় থেকে নিম্নোক্ত ক’টি লাইন উদ্ধৃত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
“Under this Constitution, the first general election of the country was held in 1973 and one of the political parties secured almost all the parliamentary seats in the National Assembly out of the total 300 seats. Virtually, it had already became a one party Parliament without almost no opposition. After the Fourth Amendment all the existing political parties joined the said National Party. …
However, the Fourth Amendment was a political decision and it ought to have been faced politically. But this amendment was opposed only by two or three members of the Paliament as submitted by the learned Attorney General himself. Besides, this amendment could have been challenged in court, even that was not done.”
(এই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে প্রায় সবক’টিতেই জয়লাভ করে। বস্তুত, কোনো বিরোধী দল ছাড়া জাতীয় সংসদ প্রায় একদলীয় সংসদে পরিণত হয়। চতুর্থ সংশোধনীর পর সব রাজনৈতিক দল কথিত জাতীয় দলে যোগদান করে।…
যা-ই হোক, চতুর্থ সংশোধনী একটি রাজনৈতিক ইস্যু এবং সেটিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা উচিত ছিল। অথচ স্বয়ং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের ভাষ্যমতে মাত্র এক-দুইজন সংসদ সদস্য এই সংশোধনীর বিরোধিতা করে। তাছাড়া এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেত। কিন্তু সেই কাজটিও কেউ করেনি।)
একজন বিচারপতি সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে কী পরিমাণ মিথ্যা ও অর্ধসত্যের মিশ্রণে কতখানি বিভ্রান্তিকর রায় দিতে পারেন, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হয়ে থাকবে খায়রুল হকের এই রায়। তিনি নিজেই যেখানে বলছেন, সাধারণ নির্বাচনে একটি দলের একতরফা বিজয়ের ফলে ১৯৭৩ সালের সংসদ একদলীয় রূপ পরিগ্রহণ করেছিল, সেক্ষেত্রে চতুর্থ সংশোধনীর এক-দুইজন বিরোধিতা করাটাই তো স্বাভাবিক। অথচ আজকের প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অসত্ উদ্দেশ্যে তিনি রায়ে এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন, যাতে মনে হতে পারে চতুর্থ সংশোধনী এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে সেটির বিরোধিতা করার মতো লোক সংসদে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন সব রাজনৈতিক দল জাতীয় দলে যোগদান করেছিল। অথচ চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭(ক) ধারা মোতাবেক রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় দল ছাড়া দেশের সব দল নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। যেখানে দেশে অন্য কোনো দলের আইনগত অস্তিত্বই নেই, সেখানে খায়রুল হক বাকশালে স্বেচ্ছায় সব দলের যোগদানের গল্প ফেঁদেছেন।
এই বিচারপতির পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে চরম ফ্যাসিবাদী বাকশালি শাসনব্যবস্থার কলঙ্ক থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধার করা। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি খায়রুল হককে সঠিকভাবেই একজন ধিকৃত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দেশকে আজ অবধারিত নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত করার গুরুতর অপরাধে বিচারপতি খায়রুল হককে অবশ্যই একদিন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এবার বর্তমান বাংলাদেশে ফেরা যাক। ২০১১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানেরই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের অনুরূপ ৩৪৫ আসনের প্রায় একদলীয় জাতীয় সংসদে তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে ২৯১ জন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী জয়যুক্ত করেছেন। সংসদে উপস্থিত একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বিলের বিপক্ষে ভোটদান করায় পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে ফলাফল দাঁড়িয়েছে ২৯১-১। সংসদে এই ভোট প্রদানের নাটকে ক্ষমতাসীন মহাজোটের নানারকম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বও প্রমাণিত হয়েছে। যে জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে সংসদের বাইরে পদযাত্রা ও বিক্ষোভ করেছেন, তারাই আবার সংসদের ভেতরে পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সুবিধাবাদিতারও বোধহয় একটা সীমা থাকা দরকার!
পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিশ্চিত হয়েছে। যে কোনো মূল্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বাসনাতেই বিচারপতি খায়রুল হকের সহায়তাক্রমে ক্ষমতাসীনরা এই বিপজ্জনক খেলায় অবতীর্ণ হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুখোশে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকে তামাশার নির্বাচনে বিজয়ী হতে চান। এ ধরনের নির্বাচনের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশবাসীর হয়েছে। সেই সংসদ মাত্র তিনদিন স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালেও আমরা অনুরূপ নির্বাচন দেখেছি। উভয় সংসদই দু’বছরের মধ্যে ভেঙে দিতে হয়েছিল। বর্তমান নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ধরে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে থাকায় এবার ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হবে না। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ব্লক এবং ভারত শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশের তত্কালীন সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছে। ২০১১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো অস্তিত্ব নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের ঘনিষ্ঠতম মিত্র। চীন সরকারও আওয়ামী লীগের প্রতি আগের মতো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। সুতরাং রাবার স্ট্যাম্প সংসদকে ব্যবহার করে ১৯৭৫ সালের আদলে বাংলাদেশে স্বৈরশাসন আবার প্রতিষ্ঠা হলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে তেমন কোনো আপত্তি উত্থাপিত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
সেই লক্ষ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে সপক্ষে রাখার জন্য ভারত এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তাদের ইসলামী জঙ্গি কার্ড অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে চলেছে। পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের সংসদে পাস হওয়ার আগের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিস্ময়কর মন্তব্য করেছেন : ‘’Our relations (with Bangladesh) are quite good. But we must reckon that at least 25 per cent of the population of Bangladesh swear by the (Jamat-e-Islami) and they are very anti-Indian, and they are in the clutches, many times, of the ISI. So a political landscape in Bangladesh can change at any time. We do not know what these terrorist elements can be upto.”
(বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং এরা ভারতবিরোধী ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইএসআইর খপ্পরে। সুতরাং বাংলাদেশে যে কোনো সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা জানি না এসব জঙ্গিগোষ্ঠী কখন কী করবে।)
বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকের আজগুবি তথ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কোথায় পেলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তার এই মন্তব্য বর্তমানে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামীকে উজ্জীবিত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে আমাদের জনগণ আইএসআইর খপ্পরে এমন মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে অবমাননাকর। মূল কথা হলো, ড. মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে একধরনের উদ্বেগের পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন হুমকিও প্রকাশ পেয়েছে। আর কুমিরছানার মতো ইসলামী জঙ্গি তত্ত্ব তো আছেই। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশে আইএসআইর খপ্পরে কতজন আছে, সেই হিসাব দিলেও তার গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (জঅড) কত শতাংশ বাংলাদেশী নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে সম্পর্কে রহস্যজনকভাবে চুপ থেকেছেন।
তার তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতবিরোধী হলেই যদি আইএসআইর এজেন্ট হয়, তাহলে ভারতবান্ধবরা নিশ্চয়ই ‘র’-এর এজেন্ট। ড. মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে ভারতবান্ধব মহাজোট সরকার যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার খপ্পরে থাকার অভিযোগ স্বীকার করে নেন, তাহলে আমাদের আর কী বলার থাকতে পারে! ঘটনার এখানেই শেষ নয়। একইদিনে সেই ভারতের রাজধানীতেই মার্কিন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত টিমোথি রোমার বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে তারা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন (সূত্র : প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০১১)। ৩০ জুনের এতসব ঘটনাও যদি আমাদের সতর্ক না করে তুলতে পারে, তাহলে আমরা স্বাধীনতারই যোগ্য নই।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭৫ সালের মিল-অমিল দু’টিই রয়েছে। মিলের অংশটাই আগে দেখা যাক। সে সময়ের মতো দেশে এখনও প্রায় একদলীয় শাসন চলছে। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনা, উভয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়েও মাত্র দুই বছরের মধ্যে একইভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। আর এখন স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবস্থান করায় জনজীবন দুর্বিষহ। রাষ্ট্রে দুর্নীতি এবং লুটপাট আগের মতোই সর্বব্যাপী। আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতিতেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সেই আমলে তিনবিঘা করিডোরের ভ্রান্ত আশায় সংবিধান সংশোধন করে বেরুবাড়ী ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। বর্তমান আমলে বিনিময়ে কোনো কিছু না পেয়েই করিডোর তো বটেই, যৌথ জরিপের নামে সীমান্তের জমিও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে তুলে দেয়া হচ্ছে।
এবার অমিলের দিকে একটু দৃষ্টি দিই। ১৯৭৫ সালে জাসদ এবং কয়েকটি বামপন্থী আন্ডারগ্রাউন্ড দল ছাড়া দেশে সংগঠিত বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না। এখন বিএনপির মতো দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এবং জনপ্রিয় দল রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলের মিলিত শক্তিও উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে এই মুহূর্তে ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তোলার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা বিরোধী দলের কতখানি রয়েছে, তা নিয়ে এবং এ বিষয়ে তাদের নীতিনির্ধারকদের একনিষ্ঠতার প্রশ্নে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক বিরাট অংশ আশির দশক থেকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তাদের চিন্তা-ভাবনায় মৌলিক এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এসেছে। সত্তরের দশকের তুলনায় বিচার বিভাগ এখন সরকারের অধিকতর নিয়ন্ত্রণে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে ২০১১ সাল যৌক্তিকভাবেই এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পুনর্জন্মের জন্য উপযুক্ত সময় বিবেচিত হতে পারে।
২০০৮ সালে মহাজোট গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে বাকশালের পুনর্জন্মের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করে ‘নবরূপে বাকশাল’ শিরোনামে মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখেছিলাম। লেখাটি ডিজিটাল নির্বাচনের এক মাস আগে ২৩ নভেম্বর ছাপা হয়েছিল। সে সময় কেউ কেউ হঠকারী লেখকের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওই লেখা থেকে আমার বক্তব্যকে প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ উদ্ধৃত করলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধিতে সহায়ক হতে পারে—
‘১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রণয়নে সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের ভূমিকা না থাকলেও আগেই বলেছি, এবারের চিত্র ভিন্নতর। তদুপরি এবারকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবক্তাদের অধিকতর অনুকূলে। সত্তরের দশকে বিশ্ব দু’টি বিবদমান শিবিরে বিভক্ত থাকায় বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর দরকষাকষির একটা সুযোগ অন্তত ছিল। আর এখন সারা বিশ্বে দাপট দেখাচ্ছে একমাত্র পরাশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্বেচ্ছাচারী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত বর্তমানে আণবিক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ। এই মিলিত শক্তি বাংলাদেশে একটি কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী একদলীয় শাসনব্যবস্থাকেই যে তাদের স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করবে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।…
কাজেই দুঃসংবাদ হচ্ছে, এবারের একদলীয় সরকার ১৯৭৫ সালের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আশঙ্কাই অধিক। জরুরি আইনকে ব্যবহার করে একটি পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে এই অনৈতিক এবং দেশের স্বার্থবিরোধী প্রক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের মতো বৈধতা দান করবে কি-না, সেই সিদ্ধান্ত চারদলীয় জোটের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তবে দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী জনগণকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তা এখনই।’
লেখাটা ছাপা হওয়ার পর প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও জনগণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়নি। উপরন্তু এই সরকারের বিগত আড়াই বছরে ঐতিহ্যবাহী বিডিআর বিলুপ্ত হয়েছে, সেনাবাহিনীর অবস্থা ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বিতর্কিত বাংলাদেশ সফরসহ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ২৯ জুনের প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও প্রকট করেছে। সুতরাং ২০০৮ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমার যে মূল্যায়ন ছিল, তার কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি।
পাঠক হয়তো আমাকে হতাশাবাদী ভাবতে পারেন। কিন্তু আমি হতাশা ছড়ানোর জন্য কলম ধরিনি। বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করে জনগণকে গণপ্রতিরোধের দিকে আহ্বান করছি মাত্র। মার্কিন সমর্থক এবং বিরোধী নির্বিশেষে প্রায় সব স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আরবের নিপীড়িত জনগণের জেগে ওঠা দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করছি। এই আরববাসীদের সংগঠিত করেই আমাদের মহানবী (স.) জালিমের বিরুদ্ধে মহান বিপ্লব করেছিলেন। এদেশের ক্ষমতাসীনরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পূর্ণ সমর্থন এবং অনুগত বিচার বিভাগ, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের শক্তিতে জনগণকে আজ তুচ্ছ বিবেচনা করছে। তবে আমি এখনও আশাবাদী যে, সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলের লড়াকু মানুষের মতো দেশের ষোলো কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষ দেরিতে হলেও গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশি-বিদেশি আগ্রাসনকে অবশ্যই প্রতিহত করবে। আমাদের জেগে ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র।