গত সাড়ে তিন দশক ধরে নিজেকে একপ্রকার লোকচক্ষুর আড়ালেই রেখেছিলেন চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন। তবে এবার হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তিনি দেখা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে। এই দেখার মাধ্যমে সাড়ে তিন দশকের ব্রত ভাঙলেন মহানায়িকা৷ সেই সৌজন্যে জন্মদিনে প্রান্তিযোগ হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷
রবিবারই প্রথম পরিজন এবং চিকিৎসকদের বাইরে অন্য কাউকে দেখা দিলেন অসুস্থ সুচিত্রা সেন৷ সেই সৌভাগ্যবান মানুষটি হলেন মুখ্যমন্ত্রীই৷ মমতা তাঁর খোঁজখবর নিয়েছেন জেনে বেলভিউতে চিকিৎসাধীন সুচিত্রাই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ বাড়িতে অভ্যাগতকে যে ভাবে আপ্যায়ন করা হয়, হাসপাতালে আইটিইউ-এর কেবিনে ঠিক সে ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মহানায়িকা জানতে চান, চা না কফি কী খাবেন৷ মুখ্যমন্ত্রী চা চেয়ে নেন৷ চা খেতে খেতে দু’জনের প্রায় পঁচিশ মিনিট কথা হয়৷ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সঙ্কটমুক্ত বলা না-গেলেও, এ দিন সুচিত্রার শারীরিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে৷ মমতাকে যে তিনি প্রায় আধ ঘণ্টা সময় দিতে পেরেছেন, তা সেই উন্নতিরই ইঙ্গিতবাহী৷
শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে দেখতে বেলভিউতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ সেদিন মহানায়িকার শারীরিক অবস্থার হঠাত্ করে অবনতি হয়েছিল৷ উদ্বেগ ছড়ায় সব মহলেই৷ কিন্ত্ত সেদিন চিকিত্সক এবং সুচিত্রা-কন্যা মুনমুনের সঙ্গে কথা বলেই ফিরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ জানিয়েছিলেন, ‘পরিজন এবং চিকিত্সক বাদে অন্য কারওর সঙ্গে দেখা করেন না মহানায়িকা৷ আমি তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেই ওঁর কেবিনে যাইনি৷’
আর এদিন মহানায়িকার সঙ্গে দেখা করার পরে ফেসবুকে মমতা লিখেছেন, ‘আমি যে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম, শারীরিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল হওয়ার পর তা জানতে পারেন সুচিত্রাদেবী৷ তখন মহানায়িকা আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷ চিকিত্সক সুব্রত মৈত্র মহানায়িকার ইচ্ছার কথা আমাকে জানালে আমি আজ হাসপাতালে ছুটে যাই৷ মিনিট পঁচিশ কথা হয় ওঁর সঙ্গে৷ সবাই জানে যে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে উনি নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে সরিয়ে রেখেছেন৷ এমনকি এখনও উনি কারও সঙ্গে দেখা করছেন না৷’
ব্রত ভেঙে মহানায়িকা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত যেমন এই দিনটিকে রেকর্ডবুকে স্থান করে দিল, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও তা যে এক বিরাট প্রান্তি, তা মুখ্যমন্ত্রীর ফেসবুক ওয়ালেই স্পষ্ট৷ এদিনই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর জন্মদিন৷ স্বাভাবিক ভাবেই মহানায়িকার সাহচর্যই জন্মদিনের সেরা উপহার হয়ে ওঠে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে৷ মহানায়িকার কেবিনে আধ ঘণ্টা কাটিয়ে বেরোনোর পর মুখ্যমন্ত্রীর চোখমুখে ছিল পরম তৃপ্তির ছাপ৷ সুচিত্রাদেবীর সঙ্গে একান্তেই কথা হয় তাঁর৷ কেবিন থেকে বেরিয়ে মেয়ে মুনমুন এবং নাতনি রাইমা ও চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ চিকিত্সার খোঁজখবর নেন৷ পরিজন ও চিকিত্সক ছাড়া অন্য কাউকে দেখা না-দেওয়ার সংকল্প ভেঙে মহানায়িকা তাঁর সঙ্গে দেখা করায় মুনমুন-রাইমার কাছে বারে বারেই তাঁর আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার কথা জানান মমতা৷ ফেসবুক বার্তাতেও ধরা পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর উচ্ছ্বাস৷ লিখেছেন, ‘কোনও সন্দেহ নেই যে, আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান৷ আমি তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পেরেছি৷ আমি মুগ্ধ ও গর্বিত যে এই প্রবাদপ্রতীম অভিনেত্রীর মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য হল৷ তাঁর ছবি আমরা অসংখ্যবার দেখেছি৷ তাঁর সঙ্গে দেখা করার মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত আবেগপূর্ণ৷’
সাড়ে তিন দশক আগে, ১৯৭৯ থেকে জনসমক্ষে আসা বন্ধ করে দিয়েছিন সুচিত্রা৷ তখনও রাজ্যের অধিকাংশ সিনেমা হলে তাঁর অভিনীত ছবি দেখতে ভিড় উপচে পড়ত৷ কিন্ত্ত তিনি চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে৷ পরিবার, পারিবারিক চিকিত্সক এবং অত্যন্ত কাছের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কারও সঙ্গে দেখাও করতেন না৷ পরের বছর উত্তমকুমার মারা গেলে কয়েক মিনিটের জন্য জনসমক্ষে এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী৷ উত্তমকুমারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে দ্রুত ফিরেও যান৷ অভিনয় জীবনে থাকাকালীন মাঝেমধ্যে বেলুড় মঠে ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন৷ মহারাজ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পর শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন৷ নয়ের দশকের মাঝামাঝি সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের ছবি তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন৷ কিন্ত্ত ভোট দিতে যাননি৷ সেদিক থেকে মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ভাগ্যবান, কারণ তাঁকে নিজে থেকেই দেখা দিয়েছেন মহানায়িকা৷ মমতার জন্মদিনের সেরা উপহার!

সাড়ে তিন দশক পর পর্দা সরালেন সুচিত্রা