বুল কাসেম হায়দার:২৫ নভেম্বর ২০১৩ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রতীক্ষিত টিকফা চুক্তি হলো। মহাজোট সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচনী সরকার তথা বহুদলীয় সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। বহু বিতর্ক এতে সৃষ্টি হলো। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার আগের সরকারের পুনর্গঠন মাত্র। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এটাকে বলছেন সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার। কিন্তু এমন কোনো সরকারের কথা সংবিধানে উল্লেখ নেই। যাই হোক, তবুও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে টিকফা চুক্তি সরকারকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো আগামী নির্বাচনে মার্কিনীদের সমর্থন পাওয়ার আশায় এক দশকের প্রতীক্ষিত চুক্তি বর্তমান সরকার স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রধান বিরোধী দল ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে অনেকটা সমর্থন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এই চুক্তি নিয়ে ব্যবসায়ী মহল থেকেও তেমন কোন প্রতিবাদ বা ধন্যবাদের সুর শোনা যায়নি।
চুক্তির সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টিকফার ফলে বাণিজ্য বিষয়ক সমস্যা এবং জিএসপিসহ (অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা) বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করার আনুষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ডিউটি ফ্রি (স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে) প্রবেশের বিষয়েও আলোচনা করা যাবে। ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের স্বীকার করেছেন, টিকফার সঙ্গে জিএসপি’র কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি এও বলেছেন যে, টিকফায় বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই।
চুক্তির খসড়ায় ১৬টি অনুচ্ছেদ ও সাতটি আর্টিকেল রয়েছে। যেখানে এই দ্বিপক্ষীয় ফোরামের কাঠামো, কার্যপদ্ধতি ও আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। চুক্তিতে মূলত চারটি বিষয় এসেছে- সংরক্ষণশীল বাণিজ্য ও বিনিয়োগনীতি পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের গুরুত্ব, দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনের গুরুত্ব এবং শ্রম অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। টিকফা চুক্তিতে উভয় পক্ষের সেবা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা দূর করা; বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়ন; আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মূলনীতি মেনে উভয় দেশের শ্রম-অধিকার বাস্তবায়ন এবং পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করতে পরিবেশ আইন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে উভয় পক্ষই জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের প্রতি আনুগত্য দেখাবে। বিশেষ করে, সনদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সম্পর্কিত ধারাগুলো অনুসরণ করতে হবে। দেশীয় এবং বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
এতে আরও বলা হয়েছে, চুক্তি বাস্তবায়নে একটি ফোরাম গঠন করা হবে, যে ফোরাম বছরে কমপক্ষে একবার বৈঠক করবে। বাংলাদেশের পক্ষে এতে প্রতিনিধিত্ব করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দিবে ইউএসটিআর। উভয় পক্ষের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা চিহ্নিত করবে এ ফোরাম। এ ছাড়া উভয় পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয় চিহ্নিত করা হবে ফোরামের মাধ্যমে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা অপসারণেও পদক্ষেপ নেবে। ক্ষেত্রবিশেষে বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের পরামর্শ চাইবে এ ফোরাম।
তবে চুক্তির আলোচ্য বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ চুক্তির সুফল বাংলাদেশের পক্ষে নেয়ার সুযোগ কম। অন্যদিকে টিকফার সাথে জিএসপি’র কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার মতো কোনো শর্তও চুক্তিতে নেই। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঈনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য টিকফা চুক্তি কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটি এজেন্ডা। একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা পাওয়ার আশাতেই আমাদের সরকার এ চুক্তিতে সই করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দিক থেকে লাভবান হতে চাইছে। প্রথমত হলো মেধাস্বত্ব আইন। ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত যে সুবিধা পাচ্ছে, তা আগে ভাগেই শেষ করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সেবা খাতের জন্যও বিভিন্ন সুবিধা নিতে চাইবে। এ চুক্তির মাধ্যমে জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা) ফিরে পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনাও নেই। তাছাড়া জিএসপি সুবিধার আওতাধীন পণ্যগুলোর অবদানও খুবই কম। তাই বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এদিকে ডব্লিউটিও’র বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব অধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে। ওষুধ শিল্পের জন্য এ সুবিধা ২০১৬ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশে কম্পিউটার ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক এই বিধিমালার কারণেই ঘটেছে। টিকফা স্বাক্ষরিত হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত এ ছাড় বন্ধ করে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসতে পারে। এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধশিল্প এবং আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও রয়েছে বহুবিধ বিপদের আশঙ্কা। তাই এ চুক্তিকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও। তিনি বলেন- এটা এমন এক চুক্তি, যা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে আরও কঠিন শৃঙ্খল, আর্থিক ক্ষতি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছে। অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতে বলছেন, এতে নাকি বাংলাদেশেরই লাভ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে প্রথম সারিতে যে দেশগুলো তাদের বেশিরভাগের সঙ্গেই এ চুক্তি নেই। আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, জনগণের সম্মতি ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের টিকফা নামের এই দাসত্বের চুক্তি স্বাক্ষরের নৈতিক অধিকার নেই। অতএব, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা জাতীয় স্বার্থবিরোধী আরেকটি দলিল, অনৈতিক ও অবৈধ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ডব্লিউটিও থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র আলাদা করে চুক্তি করতে চায়। এটা এজন্যই যে, তারা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিধি বিধানের বাইরে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খল বিস্তার করতে চায়।
টিকফা চুক্তিতে উভয় পক্ষের সেবা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা দূর করা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মূল নীতি মেনে উভয় দেশের শ্রম-অধিকার বাস্তবায়ন এবং পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করতে পরিবেশ আইন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। তাই কিছু দিক থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে। তবে তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের নেগোসিয়েশনের যথার্থতার ওপর। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, টিকফা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহে হয়েছে। বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তাই কিছুটা সংশোধনও আনা হয়েছে। তবে এ চুক্তি থেকে লাভবান হতে হলে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আলোচনার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন ভাবতে হবে, বাংলাদেশ কীভাবে এখান থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিবে। টিকফার মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল ও ডিউটি ফ্রি রফতানির সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে কাজ করতে হবে। এর আগে তিনবার ডিউটি ফ্রি সুবিধা দেয়ার কথা কংগ্রেসে উঠলেও (টিকফা না থাকার অজুহাতে) শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এখন টিকফাকে কেন্দ্র করে এ সুবিধা আদায় করে নিতে হবে। ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মেধাস্বত্ব আইনের বাস্তবায়নসহ কিছু সুবিধা পেতে চাইবে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশকে সতর্কতার সাথে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো কিছু আদায় করতে হলে টিকফা ছাড়া অন্য উৎস থেকেও পারবে। তাই টিকফার মাধ্যমে সুবিধা আদায় করে নেয়ার বিষয়েই ভাবা উচিত।
প্রসঙ্গত, টিকফার খসড়া গত ১৭ জুন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২০০২ সালে এ চুক্তির খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হলেও আলোচনা শুরু হয় আরো আগে। তবে দুর্নীতি, মেধাস্বত্ব ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে এর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। শুরুতে এ চুক্তির নাম ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন মহলের সমালোচনায় এর সঙ্গে কোঅপারেশন শব্দটি যুক্ত করা হয় এবং ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ শব্দটি বদলে দেয়া হয় ফোরাম শব্দটি দিয়ে।
এই চুক্তির ফলে সরকারকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করার সামর্থ্য ও স্বক্ষমতা অনেক অনেক বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে যে কোন চুক্তির পর আলোচনায় তেমন সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। এই চুক্তির বিষয়ে আলোচনায় দক্ষতা, সক্ষমতা ও যোগ্যতা বাড়াতে হবে। সক্ষমতা দেখাতে না পারলে আমাদের ব্যবসায় বড় রকমের ধস নেমে আসতে পারে। বিশেষ করে ডব্লিওটিও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব অধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে রক্ষা পেয়েছে। এই সুযোগ ধরে রাখার জন্য টিকফা আলোচনার সময় দক্ষতা, মেধা, সক্ষমতা প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যে কোন বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য এই চুক্তি যেমন সুযোগ করে দেবে, অন্য দিকে বৃহৎ শক্তির চাপের মুখে আমাদের অবস্থান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে-এই আশঙ্কা রয়েই গেছে।
লেখক : সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই এবং সভাপতি, জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদ
