Home / বিনোদন / চিরকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

চিরকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

শুক্রবার সকালে মহানয়িকা সুচিত্রা সেন কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুসফুসের সংক্রমণ ও বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে তিনি ২৫ দিন আগে ভর্তি হন।

একই হাসপাতালে ৩৪ বছর আগে ১৯৮০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এই মহানায়িকার দীর্ঘদিনের স্বজন, বন্ধু ও জুটি উত্তম কুমার।

উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর আকস্মিকভাবেই চলচ্চিত্র জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন সুচিত্রা সেন। নিজেকে বন্দী করে ফেলেন বাড়ির চার দেয়ালে। সুচিত্রা সেন মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিলেন। সুচিত্রা সেনের স্মৃতিকে উৎসর্গ করে তাঁর সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্যের কথা জানানো হয় টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণে।

আলোর মুখ দেখেনি প্রথম ছবি

১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি সুচিত্রা অভিনীত প্রথম ছবিটি।

উত্তম কুমারের আগে নিজের নাম

‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সুচিত্রা বলেছিলেন, ছবির পোস্টারে উত্তম কুমারের আগে তাঁর নামটাই যাওয়া উচিত।

সিনেমায় জুটি

উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চট্টোপাধ্যায় সহ বেশ কিছু নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে অসাধারণ কিছু ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি।

বলিউডেও মজবুত আসন

অসাধারণ অভিনয়শৈলী আর সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে একচেটিয়া সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি বলিউডেও মজবুত আসন গেড়েছিলেন সুচিত্রা সেন। ‘দেবদাস’, ‘আঁধি’ এবং ‘মমতা’র মতো ছবিতে সুচিত্রার অভিনয় প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অগণিত দর্শক। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ছবির প্রথম পার্বতী হয়েছিলেন সুচিত্রা। বিমল রায় পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। ছবিটিতে দিলীপ কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন সুচিত্রা।

স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা

ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনচেতা সত্তার পরিচয় দিয়েছেন সুচিত্রা সেন। দৃঢ় মনোবলের অধিকারী নারী হিসেবেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। তাঁর মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রাইমা ও রিয়া সেনও অভিনয়জগতে সাফল্য পেয়েছেন। বাংলা ও হিন্দি ছবিতে পরিচিত নাম মুনমুন, রাইমা ও রিয়া।

সত্যজিৎ ও রাজ কাপুরকে ‘না’

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবি বানাতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবিটিতে সুচিত্রা সেনকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শিডিউল জটিলতার কারণে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল সুচিত্রাকে। সুচিত্রা সেনকে না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে আর কখনোই ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিটি তৈরি করেননি সত্যজিৎ রায়। ১৯৭৪ সালে ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিটি নির্মাণ করেন দীনেন গুপ্তা। ছবিটিতে প্রফুল্লমুখী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন।

‘মেরে নাম জোকার’ খ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা, প্রযোজক ও নির্মাতা রাজ কাপুরের ছবিতে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। সে সময় আর কে ফিল্মসের ব্যানারের ছবিতে অভিনয়ের জন্য মুখিয়ে থাকতেন প্রায় সব অভিনয়শিল্পী। এ ক্ষেত্রে রাজ কাপুরের মতো নির্মাতার ছবিতে অভিনয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরল নজিরই গড়েছিলেন সুচিত্রা।

দাদাসাহেব ফালকে প্রত্যাখ্যান

হিন্দি চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকারের দেওয়া চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। ২০০৫ সালে এ সম্মাননার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সম্মাননা নিতে কলকাতা থেকে দিল্লি যেতে চাননি বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

পুরস্কার ও সম্মাননা

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার

সুচিত্রা সেনই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান তিনি।

সুচিত্রা সেনের ছবি

১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবিটি নির্মিত হলেও তা আর মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে অভিনয় করেন সাত নম্বর কয়েদি ছবিতে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ এই ২৬ বছরে তিনি ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে তিনি প্রথম ছবি করেন সাড়ে চুয়াত্তর। এ ছবিটি বক্স অফিস হিট করে।

সুচিত্রা সেনের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেঝ বউ (১৯৫৫), ভালবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭),জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুশাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০-হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫-হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।

শেষকৃত্য অনুষ্ঠান

শুক্রবার দুপুরে কলকাতার কেওড়াতলা মহা শ্মশানের চিত্তরঞ্জন দাস উদ্যানে চন্দন কাঠের চুল্লীতে বিলীন হয়ে গেলো বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়িকা সুচিত্রা সেনের দেহ।

এর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান গান স্যালুট প্রদান করা হয়। এর পর বাজানো হয় মহানায়িকার প্রিয় গান। এ সময় হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা দেব সহ হাজির ছিলেন বাংলা চচ্চিত্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা।

পরিবারের তরফে হাজির ছিলেন সুচিত্রা সেনের মেয়ে মুনমুন সেন, নাতনি রিয়া এবং রাইমা সেন।

ভারতীয় সময় ঠিক বেলা ১টা ৪১ মিনিটে এ মহানায়িকাকে চুল্লিতে স্থাপন করা হয়। হিন্দু ধর্মের প্রথা মেনে বেলা ১টা ৪৬ মিনিটে মুখাগ্নি করেন মুনমুন সেন। এ সময় কান্নাতে ভেঙ্গে পরেন মুনমুন সেন।

সুচিত্রা সেন শুধু একজন অভিনেত্রী নন। তিনি বাঙালি হৃদয়ে চিরজাগরুক একজন কিংবদন্তী। এত বছর অন্তরালে থেকেও তাঁর নাম ও রূপের জাদুতে এখনও মুগ্ধ সবাই। তাঁর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু।

আজকের নিউজ আপনাদের জন্য নতুন রুপে ফিরে এসেছে। সঙ্গে থাকার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। - আজকের নিউজ